ডোয়াইট টেক্সাসের একটি রক্ষণশীল পরিবারে পিতামাতার সাত সন্তানের মাঝে তৃতীয় পুত্র হিসাবে একটি মেকানিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ডানপিটে আর একরোখা । শৈশবকালে স্মোকি হিলের নদীর পারে অন্যসব দুষ্টু ছেলেদের সাথে সারাদিন শিকার, মাছ ধরা, পিকনিক আর তাস খেলায় বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। এসব কিছুর মাঝেও নানা প্রকার বই পড়ার প্রতি তার তীব্র আগ্রহ ছিল, বিশেষ করে সামরিক যুদ্ধের ইতিহাসের উপর লেখা গুলি ছিল তার পছন্দের। সৌভাগ্যক্রমে অল্পবয়সেই এই দুষ্টু ও একরোখা ছেলেটি একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট জিতে ভর্তি হয় আমেরিকান সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যডেট হিসাবে এবং ১৯১৫ সালে ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে সেনা অফিসার হিসেবে কমিশন অর্জন করেন । তিনি নিজ কোর্সের ১৬৪ জন সহপাঠীদের মাঝে ৬১ তম অবস্থানে অত্যন্ত সাধারণ মানের ক্যাডেট হিসাবে প্রশিক্ষণ শেষ করেছিলেন । তার কৌতুক পূর্ণ আচরণ, তাস খেলার প্রতি তীব্র নেশা, অত্যধিক ধূমপান এবং অতি সাধারণ মানের একাডেমিক গ্রেডের কারনে তার অভিভাবক এবং বন্ধুগন তার বিষয়ে খুব একটা বড় আশাবাদী ছিলেন না । তার শিক্ষক এবং প্রশিক্ষকরা ভেবেছিলেন তিনি তার কর্মজীবনে একজন পিছিয়ে পড়া দলের কর্মকর্তা হবেন।
কর্মজীবনের প্রাথমিক দিন গুলি তার এমন ভবিষ্যৎ কেই হাতছানি দিয়ে চলছিল । বিভিন্ন কম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন এবং অ্যাপয়েন্টমেন্টে চাকরির সময় তিনি বেশ হতাশায় আক্রান্ত ছিলেন কিন্তু ভাগ্যক্রমে একসময় তিনি জেনারেল ফক্স কনারের সংস্পর্শে আসেন এবং পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানের কৌশল সম্পর্কে জানার ও শেখার জন্য অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হন। শীঘ্রই তিনি, জানা ও শেখার একটি নতুন চেতনা এবং প্রজ্ঞা নিয়ে পদাতিক যুদ্ধ বিষয়ে পড়তে এবং শিখতে শুরু করেছিলেন। সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ ১৬ বছর মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৩৬ সালে এই অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। কিন্তু এর মাত্র কয়েক বছর, ১৯৪৪ সালের মধ্যে, তিনি একজন অতি সাধারণ ও অস্পষ্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল থেকে পাঁচ তারকা জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং মানব ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। এই মানুষটিই নাৎসি-অধিকৃত পশ্চিম ইউরোপে মিত্রবাহিনীর আক্রমণ -অপারেশন ওভারলর্ডের সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন। নেতৃত্ব প্রদানের প্রজ্ঞায় পারমাণবিক হামলার বিষয়ে প্রসিডেন্ট ট্রুম্যানের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি যুদ্ধের সেক্রেটারি হেনরি এল. স্টিমসনকে বলেছিলেন, “পারমানবিক বোমার আক্রমন অপ্রয়োজনীয়, কারণ জাপান আত্মসমর্পণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে” তিনি আরও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম ব্যবহার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে মানব ইতিহাসে সর্বকালের জন্য বিবর্ণ করবে।
এই মানুষটি পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ তম রাষ্ট্রপতি হয়ে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন যিনি ছিলেন ডোয়াইট ডেভিড আইজেনহাওয়ার । বই পড়ার প্রতি দারুন আগ্রহ, নতুন নতুন বিষয়ের উপর শেখার উৎসাহ, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অভিজ্ঞতায় অর্জিত শিক্ষার মাধ্যমে তিনি নেতৃত্ব দিতে শিখেছিলেন । জন্মগত বা বংশ গত ভাবে তিনি নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলিতে পরিপূর্ণ ছিলেন না বরং তিনি নিজ আগ্রহে আর কঠোর প্রচেষ্টায় নিজেকে উন্নিত করেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের একটি উজ্জ্বল উদাহরণে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, জানার আগ্রহ, শেখার ইচ্ছে এবং বই পড়ার অভ্যাসের তীব্র তাগিদ একজন অত্যন্ত সাধারণ ছাত্রকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সফল মানুষে রূপান্তর করতে পারে।
প্রতিটি পেশায়, প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি ধর্মে ও সংগঠনে নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে। নেতৃত্ব রয়েছে বয়সে তরুন বা প্রবীণদের মাঝে; পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যেও নেতা রয়েছে। আপনি হয়ত প্রায়শই কোন একজন বিখ্যাত নেতার বিষয়ে অন্য সব সাধারণ মানুষের মন্তব্য শুনেছেন, “ও তিনি তো জন্মগতভাবেই নেতা? অথবা বংশগত নেতৃত্বের অধিকারী ।” তবে, সত্যিই কোন একজন ব্যক্তি মায়ের গর্ভ হতে নেতা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন কিনা সে বিষয়টি একটি উন্মুক্ত ও অমীমাংসিত বিতর্ক হলেও কিছু স্বতন্ত্র ও সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য প্রায়ই সকল সফল নেতাদের মধ্যে দৃশ্যমান যা যে কেও ইচ্ছে করলে শিখতে বা আয়ত্ত করতে সক্ষম । পড়া, জানা ও অনুশীলনের মাধ্যমে শেখা যায় এমন কৌশল এবং প্রশিক্ষণও রয়েছে যা একজন সাধারণ নেতাকে অসাধারণ ভাবে রূপান্তর করতে পারে। অন্য যে কোন দক্ষতা অর্জনের মত, নেতৃত্ব প্রদানও শেখা যায় সুনির্দিষ্ট অভ্যাস গড়ে তোলার অনুশীলনের মাধ্যমে। ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, একজন সফল নেতার অতীন্দ্রিয় গুণাবলীর প্রয়োজন হয় না;বরং প্রতিটি সাধারণ মানুষের মাঝেই নেতৃত্ব দানের সকল উপাদান প্রকৃতিগত ভাবেই বিদ্যমান । অনুশীলন আর শেখার প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে কেও হতে পারে অনন্য নেতৃত্বের অধিকারী ।
জন এফ কেনেডি নেতৃত্ব শেখার গুরুত্বকেও চিত্রিত করে বলেছেন, “নেতৃত্ব এবং শেখা একে অপরের জন্য অপরিহার্য।” প্রায় ১২০০ জন সফল মানুষের উপর স্টিভ সিভল্ডের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তাদের সকলেরই বই পড়া এবং নতুন নতুন বিষয়ে শেখার অভ্যাস ও আগহ রয়েছে । ওয়ারেন বাফেটকে তার সাফল্যের চাবিকাঠি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি হাসলেন এবং কাছাকাছি বইয়ের স্তুপের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এলন রিভ মাস্কও একজন অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। লোকেরা জিজ্ঞাসা করেছিল কিভাবে তিনি রকেট তৈরি করতে শিখলেন; টেসলার প্রতিষ্ঠাতা বলেছিলেন, “আমি বই পড়ি।” শেখার জন্য আপনার প্রয়োজন বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হওয়া আর সময়কে সবথেকে ভালভাবে ব্যাবহার করার অভ্যাসে নিজেকে বেঁধে নেওয়া । ভবিষ্যতের রূপরেখার দিকে তাকান তবে অতীতের অভিজ্ঞতা আপনার জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। বই মানব সভ্যতার এক অসাধারণ সৃষ্টি যা বহন করে চলেছে হাজার হাজার বছরেরে কোটি মানুষের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা । এক একটি বই আপনার কাছে সন্তর্পণে পৌঁছে দিচ্ছে অন্য একজন জ্ঞানী মানুষের সারা জীবনের শিক্ষা যা আপনার মনঃ জগতের সম্প্রসারনের সবথেকে সহজ ও শক্তিশালী মাধ্যম । ইতিহাস হল জানা বা শেখার একটি চমৎকার উৎস যার মাঝে সম্ভবত লিখিত আছে, আপনি আজ যেভাবে জীবন অতিবাহিত করছেন তার সমগ্র রূপরেখার সবকিছুই। তাই বই পড়ার অভ্যাস করুন, বিশেষ করে সেই সব মহান ও সফল ব্যক্তিদের জীবনী, চিন্তা ও কর্ম পদ্ধতির উপর লিখিত বই পড়ুন যারা এ পৃথিবীতে বিশেষ ভালবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে আসীন । পড়ার অভ্যাস আপনার মনঃ দিগন্তকে প্রসারিত করতে সাহায্য করবে এবং সাফল্যের স্বপ্নে পৌঁছাতে আপনাকে শক্তিশালী করবে ।
নেতৃত্ব দিতে হলে সফলতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে শিখুন। নাম, সুখ্যাতি, অর্থ, ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি অর্জন আমাদের জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি কিন্তু সবথেকে বড় সাফল্য হল, নিজ অন্তরের এমন একটি প্রশান্ত অবস্থা যখন পৃথিবীতে আপনার বিগত অস্তিত্ব অর্থবহ ছিল বলে আপনি নিজেকে সম্মান করতে পারেন।